‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৩)


বলছিলাম বাদশা তার মেয়ের দু:খে ঘুমাতে পারছিল না। মুয়াজ্জিনের ভুল আজানের ধ্বনি তার কানে যেতেই মুয়াজ্জিনকে ডেকে পাঠালো। বাদশার পাইক পেয়াদারা যথারীতি মুয়াজ্জিনকে ধরে নিয়ে এলো। বাদশাহ মুয়াজ্জিনের ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো: কী হয়েছে?

মুয়াজ্জিন বললো: হে বাদশা নামদার! জানি না কী হয়ে গেল! মনে হচ্ছে দৈত্যের ক্ষুধা মেটে নি। ও গম্বুজের কাছে ঘুমিয়ে আছে। আমার মনে হয় ও এই শহরেই থেকে যেতে চাচ্ছে।

মুয়াজ্জিনের কথা শুনে বাদশাহ এক বুড়োকে ডেকে পাঠালো এবং তাকে প্রচুর টাকা পয়সা দিয়ে গম্বুজের খোজ খবর নিয়ে আসতে বললো। বুড়ো লোকটার তো করার কিছুই নেই। কাঁপতে কাঁপতে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে টাকাগুলো গ্রহণ করলো এবং ভয়ে ভয়ে পা বাড়ালো গম্বুজের দিকে।

আস্তে আস্তে পা ফেলে চোখ কান খোলা রেখে সতর্কতার সাথে গেল গম্বুজের কাছে। গম্বুজের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে রাতের আঁধার কেটে গিয়ে সকাল হয়ে গেল। চারদিক ফর্সা হয়ে গেল তখন। বুড়ো তখন দেখলো দৈত্যটা গম্বুজের কাছে ঘুমায় নি বরং মাটিতে পড়ে ছিল দৈত্যের কাটা পা। বুড়োর মনে হলো সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। চোখ কচলাতে কচলাতে গম্বুজের আরও কাছে গেল। কাছে গিয়ে দেখলো: নাতো, সে স্বপ্ন দেখছে না, সত্যই দেখছে,বাস্তবই দেখছে। কৌতূহলী হয়ে উঠলো বৃদ্ধ। পা টিপে টিপে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় কাঁপতে কাঁপতে উপরের দিকে গেল এবং গম্বুজের ভেতরে ঢুকলো।

ভেতরে ঢুকে তো বৃদ্ধের চোখ ছানাবড়া। সে দেখলো বাদশার সুন্দরী কন্যা আর এক সুদর্শন যুবক গম্বুজের ভেতর ফ্লোরে শুয়ে আছে। বুড়ো বুঝতে পারছিল না সে কি সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন। সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সত্যিই তারা মানুষ এবং বেঁচে আছে। খুশিতে আটখানা হয়ে গেল বৃদ্ধ। দেরি না করে দ্রুত ছুটে গেল বাদশার কাছে। বাদশাকে বললো: ‘হে বাদশা! গম্বুজের দরোজায় তো দৈত্য ঘুমোয় নি। বরং দৈত্যের একটা কাটা পা সেখানে পড়ে আছে। বিশাল ওই পা পুরো জায়গা জুড়ে নিয়েছে। আর তোমার কন্যা গম্বুজের ভেতরে নিরাপদে আছে, বেঁচে আছে। এক সুদর্শন যুবকও আছে ভেতরে তোমার কন্যার সাথে’। একথা শোনার পর বাদশার কী প্রতিক্রিয়া হলো তা শুনবো খানিক বিরতির পর। আপনারাও ভাবুন।

কী বন্ধুরা! ভেবেছেন তো! দেখুন আপনাদের চিন্তার সঙ্গে মেলে কিনা। বাদশা তার কন্যার বেঁচে থাকার সংবাদ শুনেই খুশিতে নেচে উঠলো। কী যে করবে আর বলবে ভেবে কুল পাচ্ছিল না। আনন্দের সাথে বলে উঠলো: ‘এ কাজ নিশ্চয়ই ওই যুবকের। হ্যাঁ,নিশ্চয়ই ওই যুবকের। আমি চাচ্ছি তোমরা কেউ গম্বুজের ভেতর যাও এবং তারা দুজন যেভাবে শুয়ে আছে ঠিক সেভাবে রেখেই অর্থাৎ সে অবস্থাতেই তাদেরকে নিয়ে এসে আমার পালঙ্কের পাশে তাদের রেখে দাও’!

এদিকে ঘটলো আরেক ঘটনা। বাদশার এক মন্ত্রীর ছেলে ছিল। সে বাদশার মেয়েকে ভালবাসতো। ওই মন্ত্রী যখন শুনতে পেলো বাদশার মেয়ে মরে নি বরং বেঁচে আছে, তখন মনে মনে বললো:যাক বাবা! শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের ইচ্ছে তাহলে পূর্ণ হতে যাচ্ছে, সে রাজকন্যাকে পেতে যাচ্ছে। এই ভেবেচিন্তে মন্ত্রী বাদশার দিকে তাকিয়ে বললো: “বাদশা মহাশয়! ওদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসার কী দরকার! অপেক্ষা করুন! ভোর তো মাত্র হলো! সূর্য ভালো করে উঠুক।ওদের ঘুমও ভাঙুক। তারপর না হয় কাউকে পাঠিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো এবং ওই ছেলেকে অভিযুক্ত করে তার গর্দান নেওয়ার ব্যবস্থা করবো। আর আমার ছেলের সঙ্গে আপনার কন্যার বিয়ের আয়োজন করবো”।

বাদশাহ তার মন্ত্রীর কথা শুনে ভীষণ বিরক্ত হলো। বললো: ‘জল্লাদ! মন্ত্রীর জিহ্বা কেটে ফেল’!

জল্লাদের তো কাজই হলো বাদশার আদেশ পালন করা। সে দাঁড়িয়েই ছিল আদেশের অপেক্ষায়। যখন যে আদেশ পাবে তাই করবে। সে মন্ত্রীর জিহ্বা কেটে ফেলল।

এরপর বাদশাহ আদেশ দিলো তাড়াতাড়ি গিয়ে তার কন্যা আর ওই যুবকটাকে নিয়ে আসতে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন চলে গেল এবং তাদের দুজনকে নিয়ে হাজির হয়ে গেল প্রাসাদে। প্রাসাদে বাদশার পালঙ্কের পাশেই তাদের ঘুমোনোর ব্যবস্থা করলো। কিছুই টের পেল না তারা। কিছুক্ষণ পর মালেক মুহাম্মাদের ঘুম ভেঙে গেল। সে ঘুম থেকে জেগেই দেখলো বাদশার প্রাসাদে তারই পালঙ্কের পাশে সে।

তার বিস্ময় ভাঙিয়ে দিয়ে বাদশাহ বললো: ‘এই যুবক! তুমি যে-ই হও না কেন আমার জানার দরকার নেই। তুমি আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছো এবং আমাকে ও এই মুলুকের জনগণকে ওই দৈত্যের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছো’! বাদশাহ এটুকু বলতেই তার মেয়েও জেগে উঠলো ঘুম থেকে। রাতে দৈত্যের সাথে ওই গম্বুজে যা যা ঘটেছিল সব খুলে বললো পিতাকে। বাদশাহ যুবকের বীরত্ব ও সাহসিকতার কথা শুনে বললো: ‘হে যুবক! তুমি এবার আমার কন্যাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে কবুল করো! আমি তোমার সাথে ওর বিয়ের আয়োজন করবো এবং তোমার হাতে তার হাত সঁপে দেবো’।

মালেক মুহাম্মাদ রাজি হলো এবং বাদশা আদেশ দিলো পুরো শহরকে যেন ঝলমলে করে সাজানো হয়। সাতরাত সাতদিন উৎসব হলো। সপ্তম রাতে আকদ অনুষ্ঠান হলো। রাতে মালেক মুহাম্মাদ স্ত্রীকে বললো: ‘আমার অনেক কাজ পড়ে আছে,যেতে হবে। পথ খুবই বিপদ সংকুল।যদি ফিরে আসি তাহলে তুমি তো আমার স্ত্রীই থাকবে। আর যদি ফিরে না আসি তবে তুমি আবার বিয়ে করে নিও’! রাজকন্যা মালেক মুহাম্মাদকে ‘বীর’ বলে প্রশংসা করলো।

সকালবেলা মালেক মুহাম্মাদ গেল বাদশাহর দরবারে। বললো: হে বাদশাহ! আমি আজ পার্শ্ববর্তী শহরের উজিরের কাছে যেতে চাই। ওই শহরটা দেখতে চাই!

বাদশাহ আদেশ দিলো মন্ত্রীর শহরকে যেন সাজানো হয়। তারপর মালেক মুহাম্মাদ দরবারের কতিপয় অভিজাত ব্যক্তিকে নিয়ে মন্ত্রীর শহরের দিকে রওনা দেয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *