‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৬)


মালেক মুহাম্মাদ যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছলো একটি শহরের কাছে। ওই শহরের বাদশাহ কী কাজে যেন প্রাসাদের ছাদের ওপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাদশা দেখতে পাচ্ছিল দূর থেকে সাতজন ঘোড় সওয়ার শহরের দিকে আসছে।

বাদশাহ মনে মনে বলছিল: ‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে যুবকেরা অভিজাত এবং সম্ভ্রান্তই হবে। ভালোই হলো,আমার সাত কন্যাকে ওই সাত যুবকের হাতে সঁপে দেব’। এই ভেবে বাদশাহ ওই যুবকদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কয়েকজন কর্মকর্তা পাঠিয়ে দিলেন। তারা যখন শহরে প্রবেশ করলো সোজা নিয়ে আসা হলো প্রাসাদে।

বাদশাহ যখন জানতে পেল সাত ভাই-ই শাহজাদা,ভীষণ খুশি হলো এবং ভালোমতো তাদের আদর আপ্যায়ন করলো। অবশেষে বললো: শাহজাদাগণ! আমার সাতটি মেয়ে আছে। তোমাদের সাতজনের সাথে তাদের আক্‌দ করতে চাই। মালেক মুহাম্মাদ এবং তার ভাইয়েরা বাদশার প্রস্তাব গ্রহণ করলো। বাদশার আদেশে পুরো শহরকে জাঁকজমকপূর্ণ করে সাজানো হলো। সাত দিন সাত রাত্রি ধরে শহরের লোকজন উৎসবের আমেজে মেতে রইলো এবং সপ্তম রাতে ঘটা করে আকদ অনুষ্ঠান পালন করা হলো। বাদশার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি হলো মালেক মুহাম্মাদের স্ত্রী। মালেক মুহাম্মাদ তাকে বললো: একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। সংসার ধর্ম পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যে সফরে যাচ্ছি সেটা খুবই ভয়ংকর পথ। যদি ফিরে আসি তো ভালো আর যদি না আসি তাহলে তুমি আবার বিয়ে করে নিও।

মালেকের ভাইয়েরা বেশ কটা দিন তাদের স্ত্রীদের নিয়ে ভালোভাবেই কাটালো। তারপর বাদশার অনুমতি নিয়ে আপনাপন স্ত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সফরে বের হয়ে গেল। দিন রাত তারা ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে লাগলো। চতুর্থ দিন দুপুরের খানিক আগে তারা গিয়ে পৌঁছলো একটা দূর্গের কাছে। মালেক মুহাম্মাদ দূর্গের উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে নোঙর নিক্ষেপ করে উঠে হযরত আলিকে স্মরণ করলো এবং দেয়াল টপকে কেল্লায় ঢুকে পড়লো। দরোজা খুলে দিলে ভাইয়েরাও ভেতরে ঢুকলো। কেল্লার ভেতর সাতটি কক্ষে সাতটি ভাতের পাতিল রাখা ছিল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল না। মালেক মুহাম্মাদ ভাইদের বললো: আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলো একেকজন একেক রুমে যাই। সবাই তাই করলো। কিন্তু দুপুর হতে না হতেই ঘটলো আশ্চর্য এক ঘটনা।

মালেক মুহাম্মাদ ভাইদের নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল। ওই উৎকণ্ঠার ভেতরেই মালেক দেখলো তার রুমের দরোজা খুলে অসম্ভব সুন্দরী এক মেয়ে ঢুকছে। মেয়েটির মুখে ছিল হাসি। বেশ প্রাণবন্তই লাগছিল তাকে। রুমের এক কোণে গিয়ে বসে মেয়েটি হঠাৎ কেঁদে উঠলো। মালেক মুহাম্মাদ অবাক হয়ে ভাবলো: ওই প্রাণবন্ত হাসিই বা কেন আর এই কান্নাই বা কেন! সে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে গেল মেয়েটির কাছে। বললো: তুমি কাঁদছো কেন?

মেয়েটি বললো: হে শাহজাদা মালেক মুহাম্মাদ! আমরা সাত বোন! আমি সবার ছোট। আমরা পরী হবার কারণে সবকিছুর খবর জানি। সে কারণে আমরা সাতবোনই জানি তুমি ময়না পাখি আর সোনার খাঁচার সন্ধানে যাচ্ছো। তুমি জেনে রাখো যে আমি হলাম তোমার স্ত্রী। সে কারণে আমার অন্য ছয় বোন আমাকে নিয়ে হিংসা করছে এবং তোমার আগমনের অপেক্ষায় আছে, তোমাকে মারার জন্য।

পরী আরও বললো: এক কাজ করো! আমার বোনেরা এসে পৌঁছার আগেই তুমি এবং তোমার ছয় ভাই লুকিয়ে পড়। মালেক মুহাম্মাদ তাই করলো। তাড়াতাড়ি ভাইদের নিয়ে লুকিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ ওই ছয় পরী এসে নিজ নিজ রুমে ঢুকে বুঝতে পারলো এখানে কারও হাত পড়েছে। সবাই গিয়ে ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করলো: ঘরে কেউ এসেছে নাকি! তুমি যেহেতু আগেভাগে এসেছো নিশ্চয়ই দেখেছো কে এসেছে। সত্যি করে বলো নৈলে কিন্তু মেরে ফেলবো। পরীদের ছোট্ট বোন বললো: আমি তাদেরকে দেখাতে পারি এক শর্তে। শর্তটা হলো তোমরা তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। যদি কথা দাও তাহলে আমরা শিকারে না গিয়ে প্রতিদিন ওদেরকে পাঠাবো আর আমরা নিশ্চিন্তে আরামে বসবাস করতে পারবো।

বোনেরা মেনে নিলো। ছোট পরী এবার মালেক মুহাম্মাদসহ তার সব ভাইকে সামনে হাজির করলো। ছোট পরী বললো: আমি শিকারের বিনিময়ে তোমাদের জীবন ভিক্ষা নিয়েছি। তোমরা এক্ষুণি শিকারে যাও! বলার সঙ্গে সঙ্গে মালেক মুহাম্মাদ তার ভাইদের নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলো। ছোট্ট পরী মালেকের কানে কানে বললো: প্রাণে বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি ভাগো! এদিক দিয়ে গেলে সামনে একটা নদী পড়বে। নদী পর্যন্ত যেতে পারলে আর ভয় নেই। আমার বোনেরা আর তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এই বলে মাথা থেকে এক গোছা চুল ছিঁড়ে মালেকের হাতে দিয়ে বললো: কখনো যদি আমার কথা মনে পড়ে কিংবা যদি কোনো বিপদে পড়ো এই চুলের গোছার ওপর হাত রাখবে,আমি হাজির হয়ে যাবো।

সাত ভাই শিকারের অজুহাত দেখিয়ে পালালো নদীর দিকে। এদিকে সাত পরী বসে পড়লো খোশগল্পে। কিছুক্ষণ পর ছোট বোন দূরবীন নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখলো কদ্দুর গেছে সাত ভাই। দেখলো নদীর কাছে যেতে এখনো বাকি আছে। ছাদ থেকে ফিরে এসে পরীদের বললো: সাত ভাই মিলে শিকারে ব্যস্ত। বোনেরা আবার মশগুল হয়ে পড়লো নিজেদের গল্পে। কিছু সময় পর বোনেরা আবারও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। এক বোন ছাদে যেতে চাইলে ছোট বোন তাড়াতাড়ি দূরবীন হাতে নিয়ে আগেআগে চলে গেল এবং দেখলো এখনো নদীর কাছে পৌঁছায় নি তারা। ফিরে এসে বললো: ওরা ফিরছে। বোনেরা আবারও মজে উঠলো গল্পে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই এবার বড় বোন নিজেই গেল ছাদে এবং দেখলো সাত ভাই নদীর দিকে যাচ্ছে। চীৎকার করে উঠলো সে এবং দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে সাত ভাইয়ের পেছনে ছুটলো। ছোট বোনও বড় বোনের সাথে সাথে গেল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *